

১৮ ডিসেম্বরের সেই অভিশপ্ত বিষাদময় দুপুর। সিঙ্গাপুরের তপ্ত আকাশটাও যেন সেদিন এক লহমায় আর্তনাদ করে উঠেছিল। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সেই দীর্ঘ, রুদ্ধশ্বাস নীরবতা যখন ভেঙে চুরমার হয়ে খবর এলো—ওসমানের হৃৎস্পন্দন চিরতরে থেমে গেছে, তখন কেবল একটি প্রাণ প্রস্থান করেনি, বরং বাংলাদেশের চব্বিশের বিপ্লব পরবর্তী এক মহাকাব্যিক অধ্যায়ের বিষাদময় সমাপ্তি ঘটেছে। শরীফ ওসমান হাদী—যিনি কেবল একটি নাম ছিলেন না, ছিলেন আমাদের জাতীয় বিবেকের এক অবিনাশী নক্ষত্র। ওসমানের সেই নিস্পন্দ চোখের পাতা আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন এক বিষাদময় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে— "আমরা কি তবে যোগ্য ছিলাম না তার এই অসীম ত্যাগের?"
ওসমান হাদীর গল্পের শুরুটা ছিল ১৯৯৩ সালে, ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় মাদ্রাসার একজন শিক্ষক ও ইমাম, যার আদর্শে বড় হওয়া ছয় ভাই-বোনের মধ্যে হাদী ছিলেন সবার ছোট। নলছিটির মাদ্রাসা থেকে শুরু করে ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদ্রাসা হয়ে তিনি আলিম শেষ করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ওসমানের এই জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি আমাদের নির্দেশ করে যে, একটি সুস্থ সমাজ গড়তে হলে মেধাবীদের রাজনীতিতে আসা কতটা জরুরি। রাজনীতির মাঠে তিনি বলতেন:
"মাদ্রাসার তসবিহ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি—এই দুয়ের সমন্বয়ই গড়বে আগামীর ইনসাফ কায়েমকারী বাংলাদেশ।"
"শিক্ষা যখন কেবল সনদ লাভের মাধ্যম হয়, তখন দেশ মেধাবী কেরানি পায়, কিন্তু বিপ্লবী নেতা পায় না।"
"আমি রাজনীতিক হওয়ার আগে একজন ছাত্র, আর ছাত্রের কাজ হলো সত্যকে প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণ করা এবং মিথ্যাকে বুক পেতে বাধা দেওয়া।"
তার এই উক্তিগুলো প্রমাণ করে যে, তিনি ধার্মিকতা ও আধুনিক শিক্ষার এক অনন্য সেতুবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এই দর্শন আমাদের নির্দেশ দেয় যে, আগামীর নেতৃত্ব হবে আধ্যাত্মিক নৈতিকতা ও আধুনিক বিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব মিশ্রণ।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে ওসমান রামপুরা এলাকায় আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে সম্মুখ সারিতে থেকে যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন, তা আজ ইতিহাসের অংশ। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিপ্লবের চেতনা ধরে রাখতে ২০২৪ সালের ১৩ই আগস্ট তিনি গড়ে তোলেন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। ওসমানের নেতৃত্বে এই মঞ্চ গত দেড় বছরে সারাদেশে প্রায় ৫০টি সুনির্দিষ্ট মানবিক ও সংস্কারমুখী প্রকল্প পরিচালনা করেছে। ডাটা সোর্স অনুযায়ী, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১০,০০০ পরিবারকে সরাসরি পুনর্বাসন, ২৫টি জেলায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার স্থাপন এবং প্রায় ১২,০০০ মানুষের বিনামূল্যে চোখের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল তার অবদানের সামান্য অংশ। জনসেবা নিয়ে তার দর্শনীয় উক্তি ছিল:
"ভোটের অধিকারের চেয়ে ভাতের অধিকার বড় নয়, বরং অধিকারের লড়াইটা হলো সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার লড়াই।"
"জনসেবা যদি ইবাদত না হয়, তবে রাজনীতি স্রেফ একটি বৈধ অপরাধে পরিণত হয়।"
"আমাদের রাজনীতি হবে কুঁড়েঘর থেকে সচিবালয় পর্যন্ত, যেখানে ফাইল নয়, মানুষের কান্না সবার আগে গুরুত্ব পাবে।"
এই পরিসংখ্যান ও উক্তিগুলো আমাদের নির্দেশ করে যে, ওসমানের মডেল ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য জনসেবার এক নতুন মানদণ্ড হিসেবে কাজ করবে; যেখানে নেতা হবেন সেবক, শাসক নয়। ওসমান কেবল রাজপথের যোদ্ধা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তক। তিনি ইনকিলাব মঞ্চকে একটি ‘থিংক ট্যাংক’ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। টকশোতে যখন তাকে কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন করা হতো, তখন তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলতেন:
"রাষ্ট্রের মেরামতের জন্য হাতুড়ি নয়, বরং একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগীয় কম্পাস প্রয়োজন।"
"নির্বাচন কমিশন যদি মেরুদণ্ডহীন হয়, তবে গণতন্ত্র কেবল একটি রক্তক্ষয়ী উৎসব ছাড়া আর কিছুই নয়।"
"প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া স্বচ্ছতা অসম্ভব; আমরা এমন এক বাংলাদেশ চাই যেখানে দুর্নীতি হবে একটি যান্ত্রিক ত্রুটি।"
"থিংক ট্যাংকের কাজ হলো রাজপথের উত্তাপকে নীতিনির্ধারণী টেবিলে ঠান্ডা মাথায় সংলাপে রূপান্তর করা।"
ওসমানের এই বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে, একটি দেশ কেবল শ্লোগানে চলে না। তার প্রস্তাবিত ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও নির্বাচন সংস্কার বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ আগামী দশ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম স্বচ্ছ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে। ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৫—শুক্রবার দুপুর ২:২৫ মিনিটের দিকে বিজয়নগর এলাকায় যখন তিনি ঢাকা-৮ আসনের প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, তখনই ঘাতকের বুলেট তার মাথায় বিঁধে যায়। ১১৫ ব্যাগ রক্তের বিনিময়েও তাকে রাখা গেল না। তিনি প্রায়ই মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেয়ে বলতেন:
"বুলেট যদি আমার কপালে লেখা থাকে, তবে সেটা হবে আমার শ্রেষ্ঠ মেডেল।"
"ঘাতক আমাকে মারতে পারে, কিন্তু আমার স্বপ্নের কফিন কাঁধে নিতে তারা পারবে না।”
"সত্যের পথ কণ্টকাকীর্ণ বলেই সেখানে ভিড় কম, আর আমি সেই নির্জন পথের পথিক হতে ভালোবাসি।"
"রক্ত যখন একবার রাজপথে পড়ে, তখন তা আর কেবল তরল থাকে না, তা হয়ে ওঠে আগামীর মানচিত্র।"
"তসবিহ হাতে রাখা মানুষটির হাত যখন প্রতিবাদের মুষ্টিতে পরিণত হয়, তখন স্বৈরশাসকের সিংহাসন কাঁপতে বাধ্য।"
এই মর্মান্তিক হামলা আমাদের নির্দেশ করে যে, সত্যের পথ সবসময় কণ্টকাকীর্ণ হয়; ওসমানের এই রক্ত আজ লক্ষ তরুণকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোষহীন থাকার দীক্ষা দিচ্ছে। ২০২৫ সালের শেষভাগে রাজনৈতিক সহিংসতার হার ১৫% বৃদ্ধি পাওয়া এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ০.৫% নেতিবাচক প্রভাবের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা ওসমানের অনুপস্থিতিরই বিষাদময় ফল। ওসমান হাদী আমাদের কী দিয়ে গেলেন? তিনি দিয়ে গেছেন এক আদর্শিক মশাল। তিনি বিশ্বাস করতেন:
"দল-কানা লোক দেশ দেখতে পায় না, আমি চাই দেশ-কানা মানুষ যারা মানচিত্রকে নিজের হৃদপিণ্ড মনে করবে।"
"ইনসাফ কোনো দয়া নয়, এটি নাগরিকের জন্মগত অধিকার।"
"ক্ষমতা যদি জনগণের দরজায় না যায়, তবে জনগণ একদিন ক্ষমতার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকবে।"
"বিপ্লব শেষ হয় না, বিপ্লব কেবল এক হাত থেকে অন্য হাতে স্থানান্তরিত হয়।"
"আমি চলে গেলে আমার কবরে ফুল দিও না, বরং আমার স্বপ্নের ইনসাফ কায়েমের লড়াইটা জারি রেখো।"
ওসমানের এই উক্তিগুলো আজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, মেধা পাচার ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড একটি জাতির ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। ওসমানের প্রস্থান আজ আমাদের বাধ্য করছে একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ার শপথ নিতে।
সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের সেই নিথর দেহটি যখন আজ বাংলার মাটিতে নামবে, তখন হাজারো তরুণ তার রক্তের শপথ নেবে। গুগল ট্রেন্ডস বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ওসমানের শাহাদাত নিয়ে অনুসন্ধান ২৫০% বেড়েছে। তার প্রতিটি উক্তি এখন মানুষের হৃদয়ে আগ্নেয়গিরির মতো ফুটছে। ১৮ই ডিসেম্বর এখন থেকে আর ক্যালেন্ডারের সাধারণ কোনো তারিখ নয়, এটি ওসমানের সাহসিকতা আর ঘাতকের পরাজয়ের এক মহান স্মারক।
হে মৃত্যুঞ্জয়ী ওসমান, তুমি তো চলে যাওনি, বরং আমাদের প্রতিটি ভীরুতার বুকে এক একটি আগুনের গোলা গেঁথে দিয়ে গেছ! তোমার রক্তমাখা শার্ট আজ আমাদের নতুন মুক্তির পতাকা। ওসমান হাদী মরে গিয়েও প্রমাণ করে দিলেন যে, একটি বুলেট একটি শরীরকে নিথর করতে পারে, কিন্তু একটি অমর আদর্শকে নয়। তুমি ঘুমাও শান্তিতে ভাই, আমরা জেগে আছি তোমার আদর্শের শেষ প্রহরী হয়ে।
লেখক
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব
সহকারী অধ্যাপক
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
দাউদ ইব্রাহিম হাসান
মাস্টার্স শিক্ষার্থী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

