সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের এক যুগেও রহস্যের জট খোলেনি। এখনো আসামি শনাক্তকরণ, জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও নিহতদের খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারের পর্যায়েই আটকে আছে তদন্ত। যদিও র্যাবের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হয়েছে, মামলার দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু অতীতের মতো এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি সংস্থাটি। র্যাব কোনো তদন্তকারী সংস্থা নয়। এর পরও চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি বছরের পর বছর ধরে তদন্তের নামে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। উলটো ১১১ বার পেছানো হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ। সর্বশেষ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়ে ৪ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের আগের দিন দেশের পরিস্থিতির কারণে তদন্তকারী সংস্থা র্যাব আদালতে রিপোর্ট দাখিল করতে পারেনি বলে আদালতে উল্লেখ করে।
এক যুগের বেশি সময় ধরে মামলার তদন্ত চলার কারণে নিহত দুই সাংবাদিকের পরিবারের সদস্যরা হতাশায় ভুগছে। তারা বলছে, ‘বিচার চাইতে চাইতে এখন আমরা বিচার পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছি।’ গতকাল এ ব্যাপারে কথা হয় মামলার বাদী নিহত সাংবাদিক মেহেরুন রুনির ছোট ভাই নওশের আলী রোমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে যে কোনো সংস্থা দিয়ে মামলাটি সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করতে পারে। এ ব্যাপারে আগেও যা বলেছি, এখনো দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলছি, ‘আমরা বিচার চাই। যাকে দিয়েই তদন্ত করা হোক, এটাতে যেন কোনো প্রভাব না থাকে। আমরা জানি না কারা এই মামলার তদন্তকাজ বারবার বাধাগ্রস্ত করছে।’
নওশের আলী রোমান বলেন, ‘শুধু এতটুকু বলতে পারি, র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা এ বিষয়ে কাজ করছেন না। আমাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ প্রতি বছর তারা নিয়মমাফিকভাবে বলে আসছেন, দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই নয়। ফলে যে সংস্থা দিয়েই তদন্ত করানো হোক না কেন, আমরা চাই মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং দোষীরা আইনের আওতায় আসুক।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হওয়ার ঘটনার তদন্ত কেন হবে না? ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে। ঐ সময় ফ্যাসিস্ট সরকার এই হত্যা মামলার তদন্তে বাধা দিয়েছে। এখন আমরা এটার দ্রুত তদন্ত চাচ্ছি। এজন্য যাকে দিয়ে তদন্ত করা হোক, সরকার যদি প্রভাব বিস্তার না করে, তাহলে সেটা র্যাব হোক, পুলিশ হোক আর পিবিআই হোক—এই খুনের তদন্তকাজ শেষ হয়ে প্রকৃত খুনিদের চিহ্নিত করা যাবে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ৫৮/এ/২ বাড়ির ৫ তলার এ-৪ ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। খুনের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরের দিন রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার একজন কর্মকর্তা। ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত ভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমের ওপর। তবে এর দুই মাস পর হাইকোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় র্যাবকে। সেই থেকে এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো মামলার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
র্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে নেমে তদন্ত কর্মকর্তা প্রথমে হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ খোঁজেন। এরপর আসামি শনাক্তকরণের চেষ্টা করেন, কোনো ধরনের ক্লু পেতে জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির খোয়া যাওয়া মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা করেন। এসব একটি মামলা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যক্রম, এক যুগ ধরে তদন্তের পরও সাগর-রুনি হত্যা মামলা ঠিক এরূপ প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। এখনো আসামি শনাক্তকরণ, জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও নিহতদের খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারের চেষ্টায় রয়েছে তদন্তকারী সংস্থা।
র্যাব মামলার তদন্তে নেমে গ্রেফতারকৃত আট আসামি, নিহত দুই জন এবং স্বজন মিলে ২১ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টগুলো হাতে পায় র্যাব। সে রিপোর্ট ও অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনায় দুই জনের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল পাওয়া গেছে। তবে এসব পরীক্ষায় সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি। এই মামলায় গ্রেফতারকৃত আট জনের মধ্যে পাঁচ জন— রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার দেখানো হয় পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীরকে। এদের সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। ফলে এখন এই মামলায় কেউ কারাগারে নেই।