টানা পঞ্চমবারের মতো উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। বুধবার (৩১ জুলাই) নগর ভবনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ হাজার ৭৬০ কোটি ৭৪ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেন সংস্থাটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। প্রায় সব বছর এক-তৃতীয়াংশের বেশি বাস্তবায়ন না হলেও উচ্চাভিলাষী বাজেটেই থাকছে দক্ষিণ সিটি।
গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৬ হাজার ৭৫১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে ডিএসসিসি। অথচ খরচ করতে সক্ষম হয় মাত্র ২ হাজার ৫৪১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার ৩৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। একইভাবে আগের তিনটি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নও এক-তৃতীয়াংশের কম ছিল।
২০২০ সালের মে মাসে ডিএসসিসির মেয়রের দায়িত্ব নেন শেখ ফজলে নূর তাপস। সেই হিসেবে আজ ছিল তার পঞ্চম বা শেষ বাজেট। তাই এ বাজেটটি বাস্তবতার আলোকে ঘোষণা করার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, প্রতি বছর বাজেটের আকার ও বাস্তবায়নের হার বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, এগুলো ডিএসসিসির উচ্চাভিলাষী বা লোক দেখানো বাজেট। এমন লোক দেখানো কাজে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষ আস্থা হারাবে।
ডিএসসিসির হিসাব বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর বাজেটের বড় অংশই সরকারি ও বৈদেশিক সহায়তার ওপর ভিত্তি করে ডিএসসিসি কিছু প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু গত চার বছরে বড় কোনো প্রকল্পে ডিএসসিসি তেমন টাকা পায়নি। ফলে বাজেট বাস্তবায়ন আর হয় না। তবে ডিএসসিসির নিজস্ব আয়-ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রতি বছরই যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়।
ডিএসসিসির বিগত চার বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৬ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। তবে প্রকৃত খরচ হয় মাত্র ২ হাজার ৫৪১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৬ হাজার ৭৪১ কোটি ২৮ লাখ টাকার। খরচ হয় মাত্র ১ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা, যা বাজেটের এক-তৃতীয়াংশের কম।
বাস্তবায়ন হয় না, তবু উচ্চাভিলাষী বাজেট ডিএসসিসির
একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট ঘোষণা করা হয় ৬ হাজার ৭৩১ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খরচ হয় মাত্র ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ হাজার ১১৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বাজেট ঘোষণা করে ডিএসসিসি। খরচ ছিল ১ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা।
প্রতি বছর বাজেটে তাদের কেন্দ্রীয় সরকার বা বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভর হতে হয়। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, তাদের বাজেটের ধারেকাছেও যেতে পারে না। তাই অবাস্তব উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণা না করাই ভালো। অন্যথায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়।- নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান
ডিএসসিসির হিসাব বিভাগ সূত্র জানায়, বাজেট তৈরি করার সময় সংস্থাটি বাস্তবায়ন সক্ষমতা বিবেচনা করে চাহিদা দেয়। সেই চাহিদা অনুযায়ী বাজেট তৈরি হলেও সরকার জাতীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সে অনুযায়ী বরাদ্দ দেয় না। আবার প্রতি বছর বাজেটের বড় অংশ অবাস্তবায়িত থাকলেও পরের বছরের বাজেটে তা আবার নিয়ে আসা হয়। যেমন গত বছর মোট বাজেটের মধ্যে সরকারি ও বৈদেশিক উৎস থেকে আয় ধরা হয়েছিল ৪ হাজার ৪৫৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৭১৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। চলতি বছরও সরকারি ও বৈদেশিক উৎস থেকে আয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা, যা মূল বাজেটের ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
বুধবার (৩১ জুলাই) নগর ভবনে বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে উচ্চাভিলাষী বাজেট সম্পর্কে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। জবাবে ডিএসসিসি মেয়র বলেন, ‘গত চার বছরে সরকারের যে কোনো প্রকল্প বরাদ্দ কিন্তু ধীরে ধীরে কমছে। সেক্ষেত্রে আমাদের মূল হলো নিজস্ব বাজেট। সরকারের যে অনুদান বা প্রকল্প ব্যয় যেটা আমরা পেয়ে থাকি, সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।’
তিনি বলেন, ‘করোনার পরে এবং বিশ্বে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সরকার সংকুচিত অর্থনীতির পরিকল্পনা করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সব বছরে আমরা পর্যাপ্ত খাত পাই না। আমরা যতটুকু পাই ততটুকুই বাস্তবায়ন করি। তাই সরকারের প্রকল্পে এখানে কমতি বা বাড়তি আছে। মূল বিষয় হলো আর্থিক সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে চলি।’
যে বাজেট বাস্তবায়ন করা যাবে না তা না দেওয়াই ভালো বলে মনে করেন ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘দেশের সিটি করপোরেশনগুলো স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান হলেও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল। তাই প্রতি বছর বাজেটে তাদের কেন্দ্রীয় সরকার বা বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভর হতে হয়। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, তাদের বাজেটের ধারেকাছেও যেতে পারে না। তাই অবাস্তব উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণা না করাই ভালো। অন্যথায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়।’