পরমাণু ইস্যুতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র এক অনিশ্চিত যাত্রাপথে চলছে। এই ইস্যুতে আদৌ কোনো চুক্তি হবে কি না, বলা যাচ্ছে না। চলতি মাসেই তাদের মধ্যে দুদফা বৈঠক হয়েছে। প্রথম বৈঠকের আগে ও পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুর ছিল কিছুটা চড়া, ইরান পরমাণু সমঝোতায় না এলে দেশটির বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থার পথ তিনি খোলা রাখেন। দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পর তার সূর কিছুটা বদলেছে। তিনি বলছেন, তার এ বিষয়ে তাড়াহুড়ো করে তিনি কিছু করবেন না। কুটনৈতিক পন্থাকে অগ্রাধ্যিকর দিয়ে অগ্রসর হবেন।
ওমানে ১২ এপ্রিল প্রথম দফা বৈঠক হয়। এটি ছিল বহু বছরের মধ্যে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় সামনাসামনি প্রথম আলোচনা। ইরান এতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিনিময়ে একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সুযোগ দাবি করে। জানা গেছে, বৈঠকে ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে তিন ধাপের একটি চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের কাছে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ঐ প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
প্রস্তাবে বলা হয়, পরিকল্পনার প্রথম ধাপে তেল রপ্তানির সুযোগ ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়ার বিনিময়ে তেহরান ইউরেনিয়াম ৩.৬৭ শতাংশে সমৃদ্ধিকরণ নামিয়ে আনবে ২০১৫ সালের চুক্তিতে এটা ছিল। দেশটি এখন ৬০ শতাংশের বেশি মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে। ৯০ শতাংশে পৌঁছলে এ দিয়ে পরমাণু বোমা তৈরি করা সম্ভব। দ্বিতীয় ধাপে বলা হয়, ইরান স্থায়ীভাবে উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধকরণ ছেড়ে দেবে যদি যুক্তরাষ্ট্র বাকি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং তেহরানের ওপর ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকতে ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সকে রাজি করায়। তৃতীয় ধাপে উচ্চ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়াম তৃতীয় কোনো দেশে হস্তান্তর করবে। এছাড়া জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের নিয়মিত পরিদর্শনের অনুমতি দেওয়া হবে। এই পর্যায়ে একটি সম্পূরক চুক্তি হতে পারে। ২০২১ সালের ফেরন্যারি থেকে এই পরিদর্শন বন্ধ আছে।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯ এপ্রিল রোমে দ্বিতীয় দফা বৈঠক নিয়ে কিছুটা আশা সঞ্চারিত হয়েছিল। তবে কোনো পক্ষই জোরালোভাবে আশার কথা শোনাতে পারেনি। সবার কাছ থেকে মিশ্র একরকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। ট্রাম্প আগে থেকেই বলে আসছিলেন, হয় একটা চুক্তি হবে, না হয় যুদ্ধ হবে। তিনি বলেছিলেন, আলোচনা বার্থ হলে ইসরাইল ত্বরিত জবাব দেবে। ১৬ এপ্রিল নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, ইসরাইল দিয়ে ইরানের ওপর সামরিক হামলা চালানেরা সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতের জন্য ট্রাম্প নাকচ করে দিয়েছেন। ট্রাম্প বলেন, 'নাকচ করে দেওয়া হয়েছে আমি বলছি না, এ ব্যাপারে আমার কোনো তাড়া নেই। আমি মনে করি ইরানের সামনে দেশকে নতুনভাবে গড়ার সুযোগ এসেছে… এটা আমার পক্ষ থেকে প্রথম বিকল্প, আর দ্বিতীয় বিকল্পটি আমি মনে করি ইরানের জন্য খুব খারাপ হবে।'
ট্রাম্প আগের মেয়াদে ২০১৮ ইরানের সঙ্গে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় করা পরমাণু চুক্তি থেকে বের হয়ে আসেন। জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামের চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয়টি দেশের সঙ্গে করা হয়েছিল। নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরানের অর্থনীতিকে আরো চাপের মুখে ফেলেন। পালটা পদক্ষেপ সামরিক হামলার হুমকিই কি তেহরানকে আলোচনার টেবিলে এনেছে। তেহরান অবশ্য এই দাবি অস্বীকার করেছে। দেশটির সুপ্রিম নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ওয়েবসাইটে যুক্তরাষ্ট্র আলোচ্য সূচি কেবল পরমাণু কর্মসূচির ওপর সীমাবদ্ধ রাখায় ইরান আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। এর আগে এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ বিষয়ে আলেচনায় বসতে রাজি হয়নি।
আলোচনা সফল হবে কিনা, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। ইরান যে প্রথম বৈঠকে ৩.৬৭ শতাংশ পর্যন্ত রাজি হয়েছিল, উইটকফ তাকে স্বাগত জানালেও পরে তিনি ঐ বক্তব্য থেকে সরে যান। তার এই অবস্থান পরিবর্তনকে আরাগড়ি 'স্ববিরোধী বক্তব্য' বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, যা বলার তা আলোচনার টেবিলেই স্পষ্ট করতে হবে। তবে আলোচনার থেকে কী অর্জিত হতে পারে, ওয়াশিংটন সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হতে পারছে না। তাই চুক্তির ব্যাপারটাও ঝুলে যাচ্ছে বারবার। উইটকফ বলেছেন, চুক্তি যদি হয়ও, সেটা হবে ট্রাম্প প্রশাসনের চুক্তি। ২০১৫ সালের ওবামা প্রশাসনের চুক্তি নয়।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকে, তবে একটি চুক্তিতে আসা উচিত। প্রথমত মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান চালানোর অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। কোথাও কোথাও সরকার পরিবর্তন ঘটানো গেলেও কোথাও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন ঘটেনি। দ্বিতীয়ত এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কুটনৈতিক সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সফলতা আসেনি। রাশিয়া এখনো নিয়মিত আক্রমণ করেই যাচ্ছে। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে যুদ্ধবিরতি ভেঙে নতুন করে রক্তপাত শুরু করেছে ইসরাইল। মধ্য জানুয়ারিতে ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর মনে হয়েছিল ইউক্রেন ও ফিলিস্তিনে শান্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তৃতীয়ত কুটনৈতিকভাবেও ইরানকে একঘরে করা এখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়।
হিসেবে ইরান ঐ চুক্তির সীমা লঙ্ঘন করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে। দেশটির হাতে এখন সমৃদ্ধ করা ইউরেনিয়ামের ভান্ডার মজুত আছে। তার কথা ছিল এভাবে চাপের মধ্যে থাকলে ইরান একটি 'ভালো' চুক্তি করতে রাজি হবে। এই কথা তিনি এখনো বলে যাচ্ছেন। অর্থনৈতিক সংকটের মুখে জনঅসন্তোষ বাড়তে থাকলে সরকার পতনের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
সম্প্রতি ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে ২০ বছর মেয়াদি একটি কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে। ৮ এপ্রিল রুশ পার্লামেন্টে চুক্তিটি অনুমোদিত হয়। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গেও ইরানের সম্পর্কে দূরত্ব ঘোচার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ১৬ এপ্রিল সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী খালিদ বিন সালমান তেহরান সফরে যান। সফরকালে তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি, প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসব দিক লক্ষ করলে সময়টা সামরিক অভিযানের অনুকূলে মনে হয় না।