ঢাকা
২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সন্ধ্যা ৬:২৩
প্রকাশিত : আগস্ট ১৮, ২০২৪
আপডেট: আগস্ট ১৮, ২০২৪
প্রকাশিত : আগস্ট ১৮, ২০২৪

বিজয় মিছিলে গিয়ে আর ফিরে আসেনি হৃদয়, ছেলের লাশের অপেক্ষায় মা

মো. নাসির উদ্দিন, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ডিগ্রী কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় মিয়া (২০) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয় মিছিলে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। পরিবারের একমাত্র ছেলে হৃদয় মিয়াকে (২০) হারিয়ে মায়ের কান্না আর আহাজারি যেন থামছেই না। পরিবারের দাবি, গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন হৃদয়। ঘটনার ১৪ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও ছেলের লাশ খুঁজে পাননি পরিবার ও স্বজনরা।

হৃদয়ের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের আলমনগর মধ্যপাড়া গ্রামে। ওই গ্রামের ভ্যানচালক লাল মিয়ার ছেলে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নিজের পড়াশোনার খরচ ও সংসারের হাল ধরতে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে অটোরিকশা চালাতো হৃদয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ওইদিন বিকেলে বিজয় মিছিল বের হয় গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে। সেই বিজয় মিছিলে অংশ নেন হৃদয়। মিছিলে পুলিশ টিয়ালশেল ও গুলি করলে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পুলিশ হৃদয়কে ধরে গুলি করলে মারা যাওয়ার পর টেনে হিচড়ে একটি গলিতে নিয়ে যায়। হৃদয়কে পুলিশ গুলি করে মারা সেই দৃশ্য আশপাশের লোকজন ভিডিও ধারণ করে। সেই ধারণকৃত ভিডিও দেখে স্বজনরা শনাক্ত করেছে গুলিবিদ্ধ লাশটি হৃদয়ের। তবে তার লাশ কোথায় রেখেছে পুলিশ, তা এখনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।

সরেজমিনে দেখা যায়, একমাত্র ছেলে হৃদয়কে হারিয়ে পাগল প্রায় মা। বাড়িতে রাখা ছেলের জামা-কাপড়, খেলাধুলায় পাওয়া বিভিন্ন পুরস্কার হাতে নিয়ে কাদঁছেন আর বিলাপ করছেন। প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তবুও তার কান্না যেন থামছেই না। পাশেই তার স্বামীর চোখ থেকে ঝড়ছে অঝোড়ে পানি। শোকে পরিণত হয়েছে বাড়িটি। হৃদয় বাড়ির একটি জরাজীর্ণ ঘরে থাকতো। তার বোন জামাইয়ের দেয়া একটি ঘরের একপাশে থাকে তার বাবা-মা। সেই ঘরেই নিহত হৃদয়ের জামা-কাপড় ও বিভিন্ন জিনিসপত্র রয়েছে। প্রতিদিনই ওই বাড়িতে লোকজন ভিড় করছেন।

পারিবারিক সূত্রে আরও জানা যায়, হৃদয় গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ডিগ্রী কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার দুইবোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। তার বাবা লাল মিয়া এলাকায় ভ্যান চালাতো। তবে অসুস্থ থাকার কারণে কয়েকমাস ধরে তিনি আর ভ্যান চালাতে পারেন না। এই অবস্থায় নিজের পড়াশোনার খরচ ও সংসার চালানোর জন্য কাজের সন্ধানে প্রায় তিন-চার মাস আগে গাজীপুরের কোনাবাড়ী যান হৃদয়। পরে সেখানে একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতো সে। গত ৫ আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন বিকেলে কোনাবাড়ীর কাশেমপুর সড়কের মেট্রো থানার শরীফ মেডিকেলের সামনে আনন্দ মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে গিয়েছিল হৃদয়। এসময় পুলিশ মিছিলে গুলি ছোড়ে। ভয়ে হৃদয় একটি বাড়ির পাশে লুকিয়ে ছিল। সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে সড়কে নিয়ে যায় এবং মারধর করে। পরে হঠাৎই তাকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলে। এরপর আর তার লাশ মর্গেসহ বিভিন্নস্থানে খুঁজে পাননি স্বজনরা।

ওইদিন আশপাশের বাসা থেকে ধারণ করা কয়েকটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, ১০-১২জনের পুলিশ সদস্য এক যুবককে ধরে সড়কের উপর নিয়ে লাঠিচার্জ করছে। এরপর তাকে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে মারধর করছে। এরমধ্যে হঠাৎ করেই একজন পুলিশ সদস্য সামনা-সামনি গুলি করে। এতে মুহুর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারা যায়। পরে পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে চলে যায়। এরপর আবার চারজন পুলিশ সদস্য দুইজন হাত দুইজন পা ধরে তাকে নিয়ে যাচ্ছেন। আরেকটি ভিডিও দেখা গেছে, তিনজন পুলিশ সদস্য তাকে টেনেহিঁচড়ে একটি গলির ভিতর নিয়ে যাচ্ছে। এসময় আশপাশে প্রচন্ড গুলির শব্দ শুনা যায়। এরপর ওই তিনজন তার লাশ ফেলে চলে যায়। তার একটু পর আবার দুইজন এসে তার লাশ গলির ভিতর নিয়ে যাচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শী রবিন মিয়া বলেন, কোনাবড়ীতে আমরা বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। মেট্রো থানার সামনেই আমরা অবস্থান নিয়েছিলাম। পুলিশ আমাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ালশেল ও গুলি করে। তখন অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এসময় আমরা একপাশে ছিলাম। আর হৃদয় ছিল অন্যপাশে। একপর্যায়ে হৃদয় একটি বিল্ডিংয়ের পাশে লুকিয়ে ছিল। পরে সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে সড়কের উপর নিয়ে যায়। হয়ত মনে করেছি মারধর করে ছেড়ে দিবে কিন্তু তারা গুলি করে হত্যা করেছে। এসময় চতুর্দিকে গুলি করা হয়। ভয়ে এগিয়ে যেতে পারিনি। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম তার মৃত্যু। ভেবেছিলাম পরিবেশ শান্ত হলে তার লাশ আনতে যাবো। পরে পুলিশ তার লাশ নিয়ে চলে যায়। যেখানে তাকে মারা হয়েছে সেখানে শুধু তার রক্তাক্ত লুঙ্গি পাওয়া যায়। তবে পুলিশ লাশ কোথায় রেখেছে সেটা আর পাওয়া যায়নি।

আলমনগর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার আব্দুল হামিদ বলেন, কোনাবাড়ীতে আমার দোকান রয়েছে। মিছিলের আগেই হৃদয় আমার দোকানের সামনেই ছিল। এসময় তার বোন জামাইও ছিল। তাদের সেখানে যেতে মানা করেছিলাম। তারপরও তারা আনন্দ মিছিলে যোগদান করেছে। বোনের জামাই দূর থেকে দেখেছে কিভাবে হৃদয়কে গুলি করে মেরেছে পুলিশ। কিন্তু ভয়ে কেউ সামনে যাওয়ার সাহস পায়নি। যারা হত্যা করেছে তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হোক। হৃদয়ের লাশ যেন তার পরিবার ফিরে পায়।

হৃদয়ের বোনজামাই ইব্রাহিম হোসেন বলেন, আমরা দু’জন এক বাসায় থাকতাম। ঘটনার দিন আলাদা স্থানে ছিলাম। মিছিলে গুলির ঘটনায় আমি কোনাবাড়ী থানাসংলগ্ন একটি বাসায় আশ্রয় নিই। ওই বাসার গেট থেকে দেখতে পাই চারজন পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ একজনকে চ্যাংদোলা করে থানার সামনে নিয়ে বেঞ্চের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন। হৃদয়ের মতো দেখতে হলেও গুলির ভয়ে তখন কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি। ঘটনার পর হৃদয়ের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। থানাসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও হৃদয়ের সন্ধান পায়নি। পরে ঘটনাস্থল থেকে তার পরনের লুঙ্গি পাওয়া গেলে নিশ্চিত হয় যে নিহত যুবক হৃদয় এবং তার লাশ গুম করা হয়েছে। আমরা এর সঠিক বিচার চাই।

হৃদয়ের বোন জিয়াসমিন আক্তার বলেন, ফোনে ঘটনার দিন বিকালে হৃদয়ের সাথে সর্বশেষ কথা হয়েছে। হৃদয়কে বলেছি তুমি নিরাপদে থেকে বাসায় ফিরে যাও। তাকে আমার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। এর প্রায় আধাঘন্টা পরই আমার স্বামী ফোনে জানালো আমার ভাই বেঁচে নেই। পরে ভাইয়ের ফোনে ফোন দিলে অন্য একজন ধরে বলে ফোনটি তিনি কুড়িয়ে পেয়েছেন। পুলিশ ধরে নেয়ার পরই তার পরনের লুঙ্গি খুলে ফেলেছিল। পরনে শুধু শর্ট প্যান্ট ছিল। রাত ১২টার পর স্বাভাবিক হলে তার মরদেহ আর পাওয়া যায়নি। ভাইয়ের আশা ছিল লেখাপড়া করে চাকরি করবে। বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটাবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পুলিশ শেষ করে দিল। যারা ভাইকে হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। দেশ স্বাধীনে যেন শহীদের খাতায় আমার ভাইয়ের নাম থাকে।

হৃদয়ের মা রেহেনা বেগম বলেন, আমাদেরকে ভালো রাখা ও পড়াশোনা করার জন্য কোনাবাড়িতে কাজ করতে গেছিল। ১০ হাজার টাকা কিস্তি তুলে আমার বাবাকে দিয়েছি গাড়ি চালানো শিখতে। আমার বাবা গাড়ি চালাবে। সেই কিস্তির টাকা কে দিবে। আমার বাবাটাকে মাইরা ফেলেছে পুলিশ গুলি করে। আমার ছেলের লাশ ফিরত দেন আমি দেখবো একটা বার। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই।

হৃদয়ের বাবা লাল মিয়া বলেন, বড় মেয়ের জামাইয়ের একটি ঘরে আমি স্ত্রী নিয়ে থাকি। ছেলে একটি ভাঙাচোরা ঘরে থাকে। ছেলেটা কোনাবাড়ীতে অটোরিক্সা চালাতো। ঘটনার দিন তাকে বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু ছেলে বললো, ভাইয়ের (বোন জামাই) সাথে যাবো। আমরা বাবাটা আর আসলো না। আমার বাবার লাশ ফেরত চাই।

প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
সম্পাদকঃ মো: গোলাম সরোয়ার
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮, মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1840 474666 +880 1736 786915, 
+880 1300 126 624, ইমেইল: online.bdsangbad@gmail.com (online), news.bdsangbad@gmail.com (print), ads.bdsangbad@gmail.com (adv) 
বাংলাদেশ সংবাদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram