রাজবাড়ী প্রতিনিধি: ২০০৯ সালের ২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআরের সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলার আসামি হন নারায়ণ। সেই মামলায় তারও সাজা হয়। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর কারাভোগের পর নারায়ণ কুমার দাস বাড়ি ফিরেছেন। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর এ (বর্তমান নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) অসামরিক কার্পেন্টার (কাঠমিস্ত্রি) পদে চাকরি করতেন নারায়ণ কুমার দাস (৬৩)।
বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে মুক্ত হয়ে ওইদিন রাতেই রাজবাড়ীতে ফেরেন নারায়ণ কুমার দাস। তাকে আনতে গিয়েছিলেন তার একমাত্র ছেলে আনন্দ কুমার দাস (৩৩)। দীর্ঘ ১৬ বছর পর বাবাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা মা-হারা ছেলে আনন্দ।
নারায়ণ কুমার দাস দিনাজপুরের কোতোয়ালি থানার কাঠাপাড়া গ্রামের মৃত কৃষ্ণ গোপাল দাসের ছেলে। তবে বিয়ের পর থেকেই নারায়ণের শ্বশুরবাড়ি রাজবাড়ী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের লক্ষীকোল গ্রামে থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর হলেও তিনি রাজবাড়ীতে তার শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করতেন।
জানা গেছে, দুই ভাইয়ের মধ্যে নারায়ণ কুমার দাস ছিলেন ছোট। বাবা কৃষিকাজ করতেন। নারায়ণের বয়স যখন তিন/চার বছর তখন তার বাবা কৃষ্ণ গোপাল দাস মারা যান। পরে ১৯৭৬ সালে রাজবাড়ী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের নিলু রানি পালের সঙ্গে নারায়ণ কুমার দাসের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই নারায়ণ পরিবার নিয়ে রাজবাড়ীতে ভাড়া বাসায় থাকতে শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে বিডিআর এ অসামরিক কার্পেন্টার (কাঠমিস্ত্রি) পদে যোগদান করেন। চাকরি করেই সংসার চালাতেন নারায়ণ দাস। ২০০৯ সালে পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহে তাকে জেলে যেতে হয়। নারায়ণের স্ত্রী নিলু রানি পাল (৫৫) ২০২১ সালে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। নারায়ণের এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।
নারায়ণ কুমার দাস বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের সময় আমরা পিলখানাতেই ছিলাম। আমি সদর দপ্তরে নির্মাণ শাখায় কার্পেন্টার (কাঠমিস্ত্রি) পদে চাকরি করতাম। পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহের দিন আমরা যারা সিভিল এমপ্লয়ি ছিলাম তারা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম।
পরবর্তীতে পিলখানায় যোগদানের জন্য আমাদের ডাকা হয়। আমরা যোগদান করতে পিলখানার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পরে পিলখানায় যাওয়ার পর আমাদের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। তারা আমাদের আবাহনীর মাঠে থাকতে বলেন এবং জানান অনুমতি পেলেই আমাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হবে। পরে আমাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আমাদের অনেক মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিল। সামান্য খিচুড়ি দিত, সেটা তিন-চারজন মিলে খেতাম। এরপর র্যাব জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমাদের নিয়ে গেল।
সবাই বললো আমরা নিরপরাধ, আমাদের কোনো হাতিয়ার নেই। তারা বলল কি জানো সেটা বলো। আমরা বললাম, কিছুই জানি না। কারণ আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে যেখানে ঘটনা ঘটেছিল সেটা প্রায় আধা মাইল দূরে। জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাদের জেলে পাঠিয়ে দিল। আমার এটুকুই অপরাধ পিলখানার গণ্ডগোলের দিন কেন আমি সেখানে ছিলাম। এরপর থেকেই আমার জেলের জীবন শুরু। তারা আমাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল যে আমাদের সাধারণ ক্ষমা করেছে সরকার, শুধু নিরাপত্তার জন্য কয়েক দিন জেলে থাকতে হবে। কিন্তু বিগত প্রায় ১৬ বছর আমাকে জেলে থাকতো হলো। অনেক মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে আমাকে।
তিনি আরও বলেন, জেলে পাঠানোর পর আমরা যতটুকু জানতে পারি আমাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আমাদেরকে বিস্ফোরক মামলাও দেওয়া হয়, যেটা আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৩ সালে আমি হত্যা মামলায় খালাস পাই। খালাস পাওয়ার পরও ২০১৩ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত শুধু শুধু জেল খাটলাম। হত্যা মামলায় যখন সরকার আমাকে ক্ষমা করে দিলো তখন বিস্ফোরক মামলায় আমাকে কীভাবে জেলে রাখল এটা আমার বোধগম্য নয়। কারণ হত্যা মামলা না থাকলে তো অন্য মামলা থাকার কথা না। কি কারণে আওয়ামী লীগ সরকার ১৬টি বছর বিনা কারণে আমাকে জেল খাটাল সেটাই আমি জানি না।
সাবেক এই বিডিআর সদস্য বলেন, জেলে থাকা অবস্থায় আমার স্ত্রী ২০২১ সালের মার্চ মাসে ক্যান্সারে মারা যায়, আমি দেখতে পারিনি। এটা আমার জন্য আরও বেদনাদায়ক ছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি বাসায় এলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার নিজের বলতে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনই সবকিছু। দিনাজপুর আমার বাড়ি হলে সেখানে স্থাবর-অস্থাবর কিছুই নেই আমার। জানি না সামনে ভাগ্যে কী আছে। তবে আমার অনুরোধ থাকবে সমন্বয়ক বা ছাত্ররা যারা আমাদের জন্য এতকিছু করেছেন তারা যেন আমাদের দিকে আরেকটু নজর দেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, জেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছিলাম আমার স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে। জেল থেকে আমাকে জানানো হয় আমার স্ত্রী মারা গেছে। পরে আমার ছেলে ও মেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করে। আমি খুব মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। আমাকে ডান্ডাবেড়ি পড়িয়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হতো। এটা আমার কাছে অনেক কষ্টের ছিল, যেটা স্মৃতি হয়ে থাকবে। ২০১৬/১৭ সালে এসে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম মুক্তি পাব না, ছেলে ও মেয়েদের সঙ্গে আর দেখা হবে না, জেলেই মৃত্যু হবে। কারণ আমাদের জন্য কথা বলার মতো কেউ ছিল না। জেলের মধ্যে অনেক বিডিআর সদস্য মারা গেছেন। ভগবানের অসীম কৃপা ও ছাত্রসমাজের কৃতিত্ব ভুলার মতো না। ওদের জন্যই আমি আমার সন্তানদের কাছে ফিরে আসতে পেরেছি।
নারায়ণ কুমার দাস বলেন, আমি টাকাপয়সা জমা করে রেখে যেতে পারিনি। আমার বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটবে এটাই এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে আমার স্ত্রীর ভাইদের থেকে নিয়ে এক দিন/দুই দিন চলতে পারি। কিন্তু মাসের পর মাস তো চলতে পারি না। নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তারপরও আশা আছে একটি ভালো দিকনির্দেশনা আমাদের জন্য আসবে। এই আশায় আমি বেঁচে আছি।
সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে নারায়ণ কুমার দাস বলেন, সরকারের কাছে দাবি, একটাই আমাদের চাকরি ফেরত দিবে অথবা আমার চাকরিজীবনের সকল বেতন, রেশন সবকিছু ফেরত দিতে হবে, তা না হলে চলব কীভাবে? আমি তো সরকারের জন্য সাড়ে ২৩ বছর চাকরি করেছি। আমার অপরাধটা কী আমি আজও খুঁজে পাইনি। আমি কী জন্য এত বছর জেল খাটলাম এটা আজও আমার ঢুকে না। আমি সিভিল এমপ্লয়ি হলেও সরকার আমাকে ১৫/১৬ বছর জেল খাটালো।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান নিহত ও শহীদদের উদ্দেশ্য নারায়ণ বলেন, আমাদের একটি ইচ্ছা ছিল জেল থেকে বের হয়ে ছাত্র-জনতার কবর জিয়ারত করা কিন্তু সেটা হয়ে উঠেনি। আমরা যারা মুক্ত হয়েছি তাদের আবার ১০ তারিখে ডেকেছে। তখন আমরা আমাদের স্যারদের কবর জিয়ারত ও জুলাই আগস্টে যে সকল ছাত্ররা শহীদ হয়েছেন তাদের কবর জিয়ারত করবো। কারণ তাদের জন্যই আমি আমার ছেলেমেয়েদের মুখ দেখতে পাচ্ছি। এটা আমার জন্য বিরাট পাওয়া। আমরা জেলে থেকে শুনেছি ৫ আগস্টের ঘটনা। আমরা তো দেখতে পারিনি তাদের। তাদের এই ঋণ তো আমরা শোধ করতে পারব না। তাদের কবর জিয়ারত করতেই হবে। তাদের জন্যই আমরা আজ মুক্ত জীবনে আসতে পেরেছি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তাদের সব অপরাধ যেন ক্ষমা করে দেন। কারণ তারা আমাদের জন্যই লড়েছেন।
নারায়ণ কুমার দাসের ছেলে আনন্দ কুমার দাস কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি যখন ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী তখন আমার বাবা জেলে চলে যায়। ২০১০ সালে আমার রেজাল্ট হয়, আমি পাস করি। কিন্তু টাকার অভাবে আমি লেখাপড়া করতে পারিনি। পরবর্তীতে নিজের মামার দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করি। এভাবেই সময় চলে যাচ্ছিল। ৪/৫ বছর আগে আমার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবা জেলে আর মা মারা গেল, সন্তানের জীবনে যদি অভিভাবক না থাকে তাহলে তার জীবনে আর কিছু থাকে না, যেটা আমি বুঝেছি। মা মারা যাওয়ার পর বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম। সেখানে একা কীভাবে থাকব সেটা ভেবে মামারা আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে আসে। আমার মামারা যদি না থাকতো এই ১৬টি বছর কীভাবে যেত আমি জানতাম না, কারণ আমার বাবা তো জেলে।
তিনি আরও বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে আমার বাবাকে আজ ফিরে পেয়েছি, এতে আমি খুব খুশি। এখন আমি বাবাকে পেলেও মায়ের অভাবটা ভুলতে পারছি না। একজন ফিরে এসেছেন কিন্তু আরেকজন নেই। এই অভাব কি পূরণ হবে কখনো? ১৬ বছরের দুঃখ-কষ্টের দায়দায়িত্বটা কে নেবে? ১৬ বছর পর বাবাকে পাওয়ার অনুভূতি অন্যরকম যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কিন্তু ওই ১৬ বছরটা ধরে যদি পাইতাম তাহলে জীবনটা আরও ভালোভাবে সাজাতে পারতাম। আমার জীবন, বাবার জীবন, মাও হয়তবা এভাবে মারা যেতো না। সরকারের কাছে আমার দাবি, আমার বাবা ১৬ বছর যে বিনা অপরাধে কারাভোগ করলো, এখন তার যে অবস্থা পরিশ্রম করার মতো বয়সটা আর নেই। বাবা জেলে যাওয়ার আগে কিছু করেও যেতে পারেননি। সরকারের কাছে আবেদন, আমার বাবা চাকরিটা যেন ফেরত পাই। অথবা ১৬ বছরের তার যাবতীয় ক্ষতিপূরণ দিলে সামনের দিনগুলো আমি ও বাবা কোনোরকম বেঁচে চলে যেতে পারতাম।
নারায়ণ কুমার দাসের শ্যালিকা রিতা রানি পাল বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর পর অবশেষে জামাইবাবু মুক্তি পেয়েছেন। এতদিন পর দুইটা ভাই-বোন তাদের বাবাকে ফিরে পেয়েছে, আমাদের খুব ভালো লাগছে। আমরা আমাদের বোনটাকে হারিয়েছি। দীর্ঘদিন পর জামাইবাবুকে আবার ফিরে পেয়েছি এটাই আমাদের সান্ত্বনা।