‘আমার এখনও মনে হয় যে, আমার পা আগের মতোই আছে। এটা যে কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে, এটা যে নাই সেটা মনেই থাকে না। আমি পুরো পায়ের অনুভূতি আগের মতোই পাই।’ হাসপাতালের বিছানায় বসে কথাগুলো বলছিলেন ১৫ বছর বয়সী কিশোর তামিম হোসেন।
গত ৫ আগস্ট বিকালের দিকে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাজধানীর মিরপুরে যে আনন্দ মিছিল হয়, সেটাতে অংশ নিয়েছিলেন তামিম হোসেন। একপর্যায়ে মিছিলে পুলিশ গুলি ছুঁড়লে একটি গুলি এসে পায়ে লাগে তামিমের।
দেশে জুলাই এবং অগাস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অনেকে যেমন মারা গেছেন, তেমনি তামিমের মতো আহতও হয়েছেন কয়েক হাজার। এদের কেউ গুলিতে চোখ হারিয়েছেন, কেউ পা হারিয়েছেন আবার কেউ শরীরে বুলেট নিয়েই বেঁচে আছেন না বাঁচার মতোই। তাদের পরিবারও আছে দুর্দশার মধ্যে। আহতদের কেউ হাসপাতাল ছেড়েছেন। আবার এক মাস পরও সুস্থ্য না হওয়ায় অনেকের ঠিকানা হয়েছে হাসপাতাল।
জানা যায়, ঢাকার তামিম হোসেন পড়তেন একটি হাফেজি মাদ্রাসায়। চলতি বছর মাদ্রাসা থেকে ভর্তি হয়েছিলেন একটি মাধ্যমিক স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে। গত ৫ আগস্ট মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। গুলি তার যান পায়ের পেছনের অংশে ঢুকে পাশ কেটে বেরিয়ে যায়।
তামিম বলেন, ‘গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমি রাস্তায় পড়ে যাই। পুরো ডান পা অবশ হয়ে যায়। রক্ত আর রক্ত। হাঁটতে পারছিলাম না সহজে। ওই অবস্থাতেই গুলি থেকে বাঁচতে আশ্রয় নেই রাস্তার ফ্লাইওভারে। আধাঘণ্টা পর গুলি থামলে নেমে আসি। পরে মানুষজন আমাকে হাসপাতালে নেয়।’
সেদিন মিরপুরের একটি হাসপাতাল ঘুরে তার আশ্রয় হয় পঙ্গু হাসাপাতালে। সেখান থেকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে।
তামিম বলেন, ‘কিছুদিন ড্রেসিং করে। কিন্তু আস্তে আস্তে জায়গাটা পঁচে যায়। তখন পঙ্গু থেকে আমাকে হৃদরোগে পাঠায়। সেখানে টেস্ট করার পর তারা বলে যে, পা রাখা যাবে না। এটা কেটে ফেলতে হবে। পরে পঙ্গুতে আবারও ডাক্তাররা দেখে। তারা বলে যে, পা রাখার আর কোনও সুযোগ নেই।’
তামিমের পা কেটে ফেলার পর নতুন জটিলতা শুরু হয়। পা বিহীন অবস্থার সঙ্গে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলেন না তামিম। অপারেশনের তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু পা হারিয়েও পা থাকার ‘অদ্ভুত’ অনুভূতি এখনও বয়ে চলেছেন অষ্টম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী।
তিনি বলেন, ‘প্রথম তিন-চার দিন আমি ঘুমাতে পারি নাই। আমার মনে হতো যে, পুরো পা আমার অক্ষত আছে। পায়ে যেখানে গুলি লেগেছিল, সেখানকার ব্যথা আমি এখনও অনুভব করি। অথচ সেই পা কেটে ফেলা হয়েছে। মাঝে মাঝে চুলকায়। চুলকাতে গিয়ে দেখি পা নেই। আমার যখন পা ছিল, তখন যে ফিল করতাম যে মশা কামড় দিয়েছে বা পিঁপড়া কামড় দিয়েছে, ওইরকমের ফিল হয়। আমার পা চুলকাতে থাকে। পিঁপড়া কামড় দেয়। কিন্তু আসলে কিছু নেই।’
তামিম এখন অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন নতুন জীবনে। কিন্তু তার জীবনধারা যে আজীবনের জন্য বদলে গেছে, বুঝতে পারছেন সেটাও। তামিম বলেন, ‘আমি এখন ক্রাচে ভর করে হাঁটার চেষ্টা করছি। আমি ফুটবল খেলতাম। সেগুলো মনে পড়ে। আমার বন্ধুরা খেলবে। কিন্তু আমি খেলতে পারব না -এগুলো মনে হয়। তখন আমার আম্মু ডাক্তারদের কথা বলে যে, তারা এমন পা লাগায় দিবে যে তুমি খেলতে পারবা।’
তবে পরিস্থিতি যেমনই হোক, ভবিষ্যৎ নিয়ে হাল ছাড়ছেন না তামিম। স্বপ্ন দেখছেন, বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবেন। তিনি বলেন, ‘আবু সাঈদ ভাই যখন মারা গেছে। অনেকেই আহত হয়েছে। তখন আমি বসে থাকতে পারিনি। আমার আম্মু নিষেধ করেছিল, কিন্তু আমি শুনি নাই। এখন ভাবি, আমি তো নিজেই সাহস করে আন্দোলনে গিয়েছি। নিজের একটা অঙ্গ গিয়েছে, আফসোস নাই। তবু দেশটা যেন ভালো থাকে।’
সূত্র: যুগান্তর